চট্টগ্রাম সদর সাব রেজিস্ট্রী অফিস যে দুর্নীতির আতুরঘর। ঘুষ ছাড়া ভূমি সংক্রান্ত কোন কাজ করা যেমন অসম্ভব, তেমনিভাবে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে চলছে জমির রেজিষ্ট্রেশন।
সরকারী এই কার্যালয়টি ঘুষ, অনিয়ম-দুর্নীতির আঁখড়া হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে জেলার বাসিন্দাদের কাছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, সরকার ডিজিটাল প্রযুক্তি চালুর মাধ্যমে দেশের প্রতিটি সাব রেজিস্ট্রি অফিসকে দুর্নীতিমুক্ত রাখার ঘোষনা দিয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রাম সদর সাব রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীদের অবস্থান সরকারী কর্মপরিকল্পনার বিপরীতে।প্রতিদিনই প্রকাশ্যে চলছে লাখ লাখ টাকার ঘুষ লেনদেন।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সাব-রেজিস্টি অফিসের অনিয়ম দুর্নীতির সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব রয়েছেন সাবেক সাব রেজিস্ট্রার মনিরুজ্জামান, সাবেক সাব রেজিস্টার সঞ্জয় কুমার আচায্য। এই চক্রটির সঙ্গে জড়িত হেড ক্লার্কও। সাবেক সাব রেজিস্ট্রার মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে অনিয়মের বিভিন্ন খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তাকে বদলি করা হয়। কিন্তু তার পদে স্থলাভিষিক্ত হওয়া সাব রেজিস্ট্রার সঞ্য় কুমার আচাব্যও পূর্ববর্তী কর্মকর্তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন পদে পদে।
সঞ্জয় কুমার আচায্য’র বিরুদ্ধেও রয়েছে জাল দলিল, রাজস্ব জালিয়াতি, ঘুষ গ্রহন করে জমির মালিকানা যাচাই না করে দলিল রেজিস্ট্রেশন এমন শত শত অভিযোগ । ভূমি অফিসের অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজস করে প্রতিদিনই সাব রেজিস্ট্রি অফিসে সেবা নিতে আসা মানুষদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সাবেক সদর সাব রেজিস্ট্রার মনিরুজ্জামানের সাথে যোগসাজশে বেআইনিভাবে জমি রেজিস্ট্রি করে আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকেই জমির মালিক হয়েছেন। সুত্রমতে সরকারী ফিস যতই হোক দিতে হয় অন্তত ৬ গুন। এই সাবেক দুই সদর সাব রেজিস্ট্রারসহ তাদের অনুসারীদের দৌরাত্ম্য থামেনি ৫ আগস্টের পরও। এই দুই কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠ দালালরাই এখনও জাল জালিয়াতিতে হাত পাকাচ্ছেন।
সুত্রমতে, এই দুই কর্মকর্তার বড় ঘুষ বাণিজ্যের খাত ছিলো ‘জমির শ্রেনী পরিবর্তন’। জমি রেজিষ্ট্রেশনের ক্ষেত্রে কম মুল্য দেখিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার পথও সুগম করেছেন এই দুই সাবেক সাব রেজিস্ট্রার।
সাব রেজিস্ট্রি অফিসে সেবা নিতে আসা এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নাম ব্যবহার করে এই অফিস এলাকায় দলিল লেখক সমিতির দ্বারা পরিচালিত একটি চক্র রমরমা ব্যবসা চালাচ্ছে। সাবেক এই দুই সাব রেজিস্টার সাবেক আওয়ামি ফ্যাসিস্ট সরকারের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সাথে যোগসাজসে সাব রেজিস্ট্রি অফিসের দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য বানিয়েছেন।
কথা হয় চট্টগ্রামের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর সাথে যিনি এই দুই সাবেক সাব রেজিস্টারের দুর্নীতির জালে ভুক্তভোগী।
তিনি জানান, চট্টগ্রাম গোলপাহাড় মোড়ে একটি ভবনে ‘এম এফ সি রেস্টুরেন্ট’ নামের ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানে ১৯ বছর ধরে ব্যবসা করে আসছিলেন তিনি। ভবনটির মালিক জনৈক ওমর ফারুকের সাথে ওই ভুক্তভোগীর ভাই মোঃ ইলিয়াসের চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিলো ২০১২ সালের ১৭ ই জানুয়ারি। (ভাড়াচুক্তি, দলিল নম্বর ১১৫৬)। পরবর্তীতে ২০২৪ সালের ২৯ শে জুন ওমর ফারুকের সাথে সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগীর একটি বিক্রয় সংক্রান্ত চুক্তি হয়, যার দলিল নম্বর ৮২৫৯।
কিন্তু ওমর ফারুক ও তার মা শামীম আরা বেগম ২০২২ সালের ২২ শে সেপ্টেম্বর যুবলীগ নেতা চট্টগ্রামের আলোচিত সন্ত্রাসী আরশাদুল আলম বাচ্চুর সাথে ভিন্ন একটি বায়না চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। (দলিল নম্বর ১৫৪৪৩)। সাবেক সাব রেজিস্ট্রার মনিরুজ্জামান এই সম্পত্তির যথাযথ মালিকানার কাগজপত্র যাচাই না করে আর্থিক সুবিধা নিয়ে যুবলীগ নেতা বাচ্চুর পুরোনো চুক্তিটি রেজিস্ট্রেশন করিয়ে দেন। পরবর্তীতে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিতে ২০২৪ সালের ৩০ শে এপ্রিল এই সম্পত্তির ৫ শতাংশ আরশাদুল আলম বাচ্চুর অনুকূলে হেবা (দান) হিসেবে নথিভুক্ত করেন। এরই মধ্যে মনিরুজ্জামানের বদলি হলে সাবেক সাব রেজিস্টার সঞ্জয় কুমার আচার্য ওই সম্পত্তির যথাযথ মালিকানার কাগজপত্র যাচাই না করে হেবা দলিলটি রেজিস্ট্রেশন করেন।
নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ওমর ফারুক ও তার মা শামীম আরা হেবামুলে দানপত্র তৈরি করলেও জমিটির বিএস খতিয়ানে ওমর ফারুক বা তাহার মাতা শামীম আরা বেগমের নামে রেকর্ড ভুক্ত নয়। আইন অনুযায়ী এই দানপত্র ও বায়না দলিলটি অবৈধভাবে সম্পাদিত হয়।এছাড়া ওই বিএস খতিয়ান সংশোধনের একটি মামলাও চলমান ছিলো।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী জানান, ওই জমিতে তিন তলা ভবন ছিলো। এ সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি মামলা চট্টগ্রাম আদালতে চলমান রয়েছে। উক্ত মামলা সমূহে সম্পত্তিটির কোন প্রকার হস্তান্তর করার উপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ওমর ফারুক, আরশাদ বাচ্চু গং সাবেক সাব রেজিস্টার মনিরুজ্জামান ও সঞ্জয় কুমার আচার্য সাথে যোগসাজসে সম্পত্তি হস্তান্তর করেন।
ভুক্তভোগীর দাবি, সাবেক দুই সাব রেজিস্টার শুধুমাত্র অর্থের লোভে ওই সম্পত্তির সবকিছুর অবগত থেকেও জমির বায়না ও দানপত্র রেজিস্ট্রেশন করে। এতে করে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যুবলীগ নেতা আরশাদ আলম বাচ্চুর সাথে এই দুই সাব রেজিস্টারের গভীর সম্পর্ক ছিলো। সাবেক এমপি মহিউদ্দিন বাচ্চু ও যুবলীগ নেতা আরশাদ আলম বাচ্চুর ব্যবসা ছিলো জমির দলিল কিনে জমি দখল। পরে সেটি সুবিধা অনুযায়ী রেজিষ্ট্রেশন। বিগত সরকারের আমলে চট্টগ্রামের সাব রেজিস্ট্রি অফিস ছিলো দুই বাচ্চুর জালিয়াতির মাঠ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এই অফিসে কর্মচারী ও দালালের রয়েছে ১৩ সদস্য বিশিষ্ট সিন্ডিকেট। দলিল রেজিষ্ট্রেশন, অন্নাসি ও নকল উত্তোলনসহ অন্যান্য কাজে সেবা প্রার্থিদের হয়রানি, ঘুষ দাবিসহ বিভিন্ন অভিযোগে দেশের ৩৫ টি সাব রেজিস্টি অফিসে অভিযান পরিচালনা করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। যার মধ্যে চট্টগ্রাম সদর সাব রেজিস্টি অফিসও অন্যতম। অভিযানে জেলা রেজিস্টি অফিসসহ সাব রেজিস্টি অফিসের বিরুদ্ধে নানান দুর্নীতির অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে। এই দুই সাবেক সাব রেজিস্টারের বিরুদ্ধে রয়েছে অনিয়ম ঘুষ গ্রহন এবং দলিল জাল জালিয়াতির নানান অভিযোগ। তাদের অন্য জেলায় বদলি করা হলেও তাদের রেজিষ্ট্রেশন করা জাল দলিল এর প্রভাব এখনো রয়ে গেছে। এসব অবৈধ দলিল ব্যবহার করে বেআইনি ভাবে সম্পত্তি হস্তান্তর করা হচ্ছে এখনও।